
চিটাগং ট্রিবিউন ডেস্ক
দুজনই বাংলাদেশ দলের সাবেক অধিনায়ক। খেলোয়াড়ি জীবনে জাতীয় দলে তাঁদের অবদান ছিল অসামান্য। তবে তাঁদের সেই পরিচয় ও ভাবমূর্তি এখন অনেকটাই অতীত। দুজনের একজন আমিনুল ইসলাম, আরেকজন তামিম ইকবাল।
ক্রিকেটাররা দেশের ক্রিকেটের প্রশাসনে এলে খেলাটা রাজনীতির পঙ্কিলতামুক্ত হবে, একসময় এমন আশা ছিল। কিন্তু বিসিবির পরিচালনা পর্ষদের ৬ অক্টোবরের নির্বাচন সামনে রেখে এই দুজনকে ঘিরে ক্রীড়াঙ্গনে যে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তার মূলে সেই রাজনীতিই। পরিণতিতে বিসিবির নির্বাচনসংক্রান্ত বিতর্ক এরই মধ্যে আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে।
সরকারপন্থী আমিনুল বনাম বিএনপির তামিম
সাবেক সভাপতি ফারুক আহমেদকে সরিয়ে দেওয়ার পর গত ৩০ মে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি) মনোনীত কাউন্সিলর হিসেবে বিসিবি সভাপতির দায়িত্ব নেন বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টে ভারতের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করা আমিনুল। শুরুতে তিনি বলেছিলেন, তাঁর লম্বা সময় বিসিবির দায়িত্বে থাকার ইচ্ছা নেই; নির্বাচন দিয়েই সরে যাবেন।
কিন্তু ঢাকা বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার কাউন্সিলর হয়ে সেই আমিনুলই এখন বিসিবির পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচনে অন্যতম প্রার্থী। পরিচালক নির্বাচিত হলে যিনি পরিচালকদের ভোটে হওয়া বোর্ড সভাপতি পদেও নির্বাচন করবেন। আমিনুলের অবস্থান পরিবর্তনে যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার সরাসরি প্রভাব আছে বলে জানা যায়। ১২ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে আমিনুল নিজেও বলেছেন, ‘অসমাপ্ত’ কাজ শেষ করার জন্য এনএসসি থেকে তাঁকে সভাপতির দায়িত্বে থাকতে বলা হয়েছে।
এ বছরের ১০ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণার পর থেকেই শোনা যাচ্ছিল, তামিম ইকবাল বিসিবির নির্বাচনে অংশ নেবেন। সেই আলোচনা সত্যি করে ওল্ড ডিএইচএসের কাউন্সিলর হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছেন তামিম এবং আমিনুলের মতো তিনিও পরিচালক নির্বাচিত হলে বোর্ড সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে শোনা যাচ্ছে।
আমিনুল যেমন বিসিবির নির্বাচনে ‘সরকারদলীয়’ প্রার্থী হিসেবে পরিচিতি পেয়ে গেছেন, তেমনি তামিমের পেছনেও আছে বিএনপির সমর্থন। বিসিবির সাবেক সভাপতি ও বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য আলী আসগর লবি বেশ আগেই সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, বিসিবির এবারের নির্বাচনে তামিম বিএনপির প্রার্থী।
আলী আসগরের এ বক্তব্য তামিম ও বিএনপিকে কিছুটা অস্বস্তিতে ফেললেও সূত্র জানিয়েছে, লন্ডনে বিএনপির হাই কমান্ড থেকে সবুজসংকেত পেয়েই কথাটা বলেছিলেন লবি। পরবর্তী সময়ে হাই কমান্ড থেকে একই বার্তা পেয়েছেন বিএনপিপন্থী ক্রীড়া সংগঠকেরা। তখন থেকেই তামিমের হয়ে নির্বাচনের মাঠে নামেন তাঁরা।
২১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর এক হোটেলে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে কাউন্সিলর মনোনয়নে অনিয়মের অভিযোগ করেন জেলা, বিভাগ ও ক্লাব–সংশ্লিষ্ট সংগঠকেরা। সেখানেও তামিমের আশপাশে থাকা সবাই ‘বিএনপির লোক’ হিসেবে পরিচিত। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঢাকার সাবেক মেয়র প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকার ছেলে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর ছেলে ইসরাফিল মাহমুদ চৌধুরী। ইশরাক বিসিবির নির্বাচনে ব্রাদার্স ইউনিয়নের কাউন্সিলর।
আমিনুল ইসলামের প্রতি সরকারের সমর্থনের সমালোচনা করে বিএনপির ক্রীড়া সম্পাদক ও জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল হক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিসিবির নির্বাচন নিয়ে ক্রীড়া উপদেষ্টার স্বৈরাচারী মনোভাব কোনোভাবেই কাম্য নয়। এটি ক্রিকেট খেলাটাকেই কলুষিত করছে।’ তামিম ইকবালের প্রতি বিএনপির সমর্থনের ব্যাপারে জানতে চাইলে অবশ্য তিনি কোনো মন্তব্য করেননি। তবে বলেছেন, ‘তামিম বলে নয়, আমরা চাই ক্রিকেটে যোগ্য নেতৃত্ব আসুক।’
তামিমের বিএনপি–সংশ্লিষ্টতা এ মুহূর্তে ক্রীড়াঙ্গনে আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ালেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পরপর ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার সঙ্গেও তাঁর সখ্য সবার দৃষ্টি কেড়েছিল। দায়িত্ব নেওয়ার পর ক্রীড়া উপদেষ্টা যেদিন প্রথম মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে যান, বিসিবির কেউ নন, তামিমই সেদিন তাঁকে পুরো স্টেডিয়াম ঘুরিয়ে দেখান। এরপরও তামিমের সঙ্গে ক্রীড়া উপদেষ্টার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল, যেটিতে ভাঙন ধরে গত ১০ মে তামিম তাঁর শহর চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত বিএনপির তারুণ্যের সমাবেশে যোগ দিলে।
নির্বাচন নিয়ে বিতর্কের শুরু যেভাবে
এই প্রথম বিসিবির নির্বাচনে দুজন সভাপতি প্রার্থী মুখোমুখি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হচ্ছেন এবং দুজনকেই অনায়াসে বাংলাদেশের ক্রিকেটের কিংবদন্তি বলা যায়। এমন দুজন ক্রিকেট ব্যক্তিত্বের যে কাউকে সভাপতি হিসেবে পেতে যাওয়ার সময়টা বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য হতে পারত উৎসাহ-উদ্দীপনার। কিন্তু সেটি না হয়ে তাঁদের পাল্টাপাল্টিতে নির্বাচনটাই এখন হয়ে পড়ছে বিতর্কিত।
নির্বাচনের জন্য বিসিবিতে কাউন্সিলরদের নাম জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ছিল ১৭ সেপ্টেম্বর। কিন্তু ১৮ সেপ্টেম্বর যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার প্রধান সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারদের কাছে বিসিবি সভাপতি আমিনুল ইসলাম স্বাক্ষরিত একটি চিঠি যায়। চিঠিতে বলা হয়, বিসিবির কাউন্সিলর হিসেবে জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার অ্যাডহক কমিটির সদস্যদের মধ্য থেকে নাম প্রেরণের বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা যথাযথভাবে মানা হয়নি। আগের ফরম বাতিল করে তাই বিসিবি থেকে পাঠানো নতুন ফরম যথাযথভাবে পূরণ করে ২২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে কাউন্সিলরের নাম পাঠাতে হবে।