শনিবার, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২৫

সৈকত রক্ষায় প্রশাসন ব্যর্থ, সিন্ডিকেটের দাপট অব্যাহত

বিশেষ প্রতিবেদক 
সমুদ্রের পাড়ে একের পর এক নতুন দোকান গড়ে উঠছে। কক্সবাজার সৈকতের বালিয়াড়ি দখল করে নির্মিত এসব অবৈধ স্থাপনা ধীরে ধীরে নষ্ট করছে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। কলাতলী ও সুগন্ধা পয়েন্টে রাতারাতি দোকান বসে যাচ্ছে, ফুটপাত ও সড়ক দখল করে বসছে শতাধিক হকার। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া ছবি ও ভিডিও ইতিমধ্যেই জনমনে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। স্যোসাল মিড়িয়া ও মাল্টিমিডিয়া সংবাদ মাধ্যমে দেখা গেছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের বদলির পরে এমন কর্মকান্ড।
এই অবৈধ দোকান নির্মাণ ও হকার সিন্ডিকেটের পেছনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন কক্সবাজারের আলোচিত দুই ব্যক্তি, জাকির হোসেন ও নূরুল হুদা ওরফে গুরামিয়া। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রশাসনের নীরবতার সুযোগে দীর্ঘদিন ধরে তারা সমুদ্র সৈকত দখল ও অপরাধ সাম্রাজ্য বিস্তার করছেন। অবৈধ দোকান নির্মাণ, হকার সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে পর্যটন এলাকায় নানা অপরাধের অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের। মামলা ও কারাভোগের ইতিহাস থাকলেও রহস্যজনকভাবে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছেন তারা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, একসময় সৈকতে ঝিনুকের মালা বিক্রি করতেন জাকির, আর গুরামিয়া ছিলেন ডাকাত ও ছিনতাইকারী হিসেবে কুখ্যাত। ২০১৭ সালে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাগ্নের পরিচয় ভাঙিয়ে এবং প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা কাজী রাসেলের ঘনিষ্ঠ হয়ে দ্রুতই ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন তারা। আওয়ামী লীগের মিছিল-মিটিংয়ে জনসমাগম ঘটানো, অর্থ যোগান দেওয়া এবং দলীয় পরিচয়ে ব্যবসা বিস্তার করে পর্যটন এলাকায় প্রভাব বিস্তার করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক (প্রদিবেদকের কাছে সংগৃহীত) স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, দুজনের সিন্ডিকেট মিলে অবৈধভাবে ৭৪ টি নতুন করে কার্ড কিনেছেন আর রাতের অন্ধকারে ৩৪ টি দোকানও বসানোর চেষ্টা করছেন তারা। এছাড়া সৈকতের বালিয়াড়ি দখল করে দোকান নির্মাণ, শতাধিক হকার থেকে দৈনিক চাঁদাবাজি,মাদক ও পতিতাব্যবসা নিয়ন্ত্রণ,কটেজ জোনে মাসোহারা ও বিচার-বাণিজ্য, অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া এসব কার্যক্রম প্রকাশ্যেই চলছে। তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা সিন্ডিকেটের কারণে সাধারণ ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, পর্যটকরা ভোগ করছেন হয়রানির শিকার।
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, গুরামিয়ার বিরুদ্ধে অন্তত ৮টি মামলা রয়েছে-ডাকাতি, অস্ত্র, মারামারি ও মাদক আইনে। কিছুদিন আগেও জুলাই আগষ্টের আন্দোলনের মামলায় জেল কেটেছেন তিনি। এছাড়া এর আগে একাধিকবার কারাভোগও করেছেন। জাকিরের বিরুদ্ধেও রয়েছে চাঁদাবাজি ও দখলবাজির মামলা। কিন্তু রাজনৈতিক যোগাযোগ ও প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তাদের সখ্যতার কারণে তারা বারবার ছাড় পেয়েছেন।
সৈকতের বালিয়াড়ি দখল করে দোকান বসানো সরাসরি পরিবেশ আইন ভঙ্গ। এতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে এবং সৈকতের সৌন্দর্য হারাচ্ছে। পরিবেশবাদীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, “প্রশাসনের নীরবতা কক্সবাজারকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে।”
তবে স্থানীয়দের প্রশ্ন-প্রমাণ, মামলা, আওয়ামীলীগের মিছিলের ভিডিও ফুটেজ ও কারাভোগের রেকর্ড থাকার পরও প্রশাসন কেন এতদিন নিষ্ক্রিয়?
ব্যবসায়ীরা বলছেন, জাকির-গুরামিয়ার দাপটে কেউ মুখ খুলতে সাহস পান না। প্রতিবাদ করলে হুমকি আসে। জীবনের নিরাপত্তা হারিয়ে চলা ফেরা করতে হয়, টাকার কাছে জিম্মি সকল রাজনৈতিক দলের কর্মীরা তাদের সাথে শো-ডাউন করে, ফলে সাধারণ মানুষ ও পর্যটকরা নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছেন।
সুগন্ধা ঝিনুক মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি জয়নাল উদ্দিন জানান, “আমি নিজেও এসবের প্রতিবাদ করে হুমকির মুখে পড়েছি। আমার সাধারণ ব্যবসায়ীদের সাথে অন্যায় করে আওয়ামীলীগের সুবিধাভোগি কোন সিন্ডিকেটকে অবৈধভাবে এসব দোকান বসাতে দেয়া হবে না।  জেলা প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করে এর সুষ্ঠু সমাধানের জন্যে আমরা কাজ করছি।”
পর্যটন সেলের নির্বাহী ম্যাজিট্রেট আলিদুর রহমানের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করেও কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।
অভিযোগের সত্যতা জানতে চাইলে নুরুল হুদা প্রকাশ গুরা মিয়া প্রথমে সব অভিযোগ মিথ্যা বানোয়াট দাবী করেন। পরে প্রতিবেদককে মানহানি মামলার হুশিয়ারি দিয়ে জানান, “বিএনপি জামাতের অনেকে এসব দোকান নির্মান করছে তাদের ফোন করেন। আমি যখন যে দল ডাকে সে দলের সাথে যায় ব্যবসায়ের স্বার্থে। বিএনপির লোকেরা জোর করে আমার পদ দখল করেছে।”
জাকের হোসেন জানান, “আমার একটি মাত্র দোকান আর একটি মাত্র কার্ড আছে, ৫ আগষ্টের পর আমাকে দোসর বানিয়েছে।’ এই বিষয়ে আমি মন্তব্য করতে চাইনা আমার আইনজীবীর সাথে কথা বলে বিস্তারিত জেনে নেন বলে জানান মুঠোফোনে।
অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিট্রেট জানান,“ আমাকে বেশ কয়েকজন অভিযোগ করেছেন বিষয়টি এছাড়া অস্থায়ী ভাবে কিছু দোকান বসানোর কথা রয়ছে। তবে অবৈধ স্থাপনা ও দখলের প্রমাণ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
অন্যদিকে ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদ তিনিবলেন, “বীচ দখল করে কোনো অবৈধ দোকান বা মার্কেট বসানো ট্যুরিস্ট পুলিশ সমর্থন করে না। কার কাছ থেকে অনুমোদন পেয়েছে তা বোধগম্য নয়। আমরা ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসন ও উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানিয়েছি সহযোগিতার জন্য। নতুন জেলা প্রশাসককে এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। খুব শীঘ্রই উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে।”
সব প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও কক্সবাজারের পর্যটন এলাকায় বছরের পর বছর দাপট দেখিয়ে চলেছেন জাকির হোসেন ও গুরামিয়া। মামলা, কারাভোগ, সাংবাদিকদের হাতে থাকা ভিডিও কোনো কিছুই তাদের প্রভাব কমাতে পারেনি। প্রশাসনের দায়সারা বক্তব্যে আস্থা হারাচ্ছেন স্থানীয়রা। প্রশ্ন উঠছে, প্রভাবশালী এই দুই ব্যক্তির কাছে কি কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প জিম্মি হয়ে পড়েছে?

সর্বাধিক পঠিত