টেকনাফ পৌরসভা: নাগরিক সেবার সংকট, নতুন প্রশাসক নিয়োগ নিয়ে আশা ও জল্পনা

মোহাম্মদ কিফায়ত উল্লাহ, টেকনাফ
দেশের দক্ষিনের সর্বশেষ সীমান্ত উপজেলা টেকনাফে পৌরসভা প্রশাসনের কার্যক্রমে দীর্ঘদিন ধরে ধীরগতি এবং নাগরিক সেবার ঘাটতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দেশের সরকার পরিবর্তনের প্রায় চৌদ্দ মাস অতিক্রান্ত হলেও পৌরসভা প্রশাসনের মাধ্যমে নাগরিকরা কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন না। রাস্তাঘাটের অবনতি, ড্রেনেজ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রশাসনিক জটিলতা-এসবই সাধারণ নাগরিকের দৈনন্দিন জীবনকে জটিল করে তুলেছে।
টেকনাফ পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা সৈয়দ আলম বলেন, “আগে মেয়র প্রতিদিন থাকতেন, তাই ট্রেড লাইসেন্স বা অন্যান্য সেবা দ্রুত পাওয়া যেত। এখন ইউএনও সপ্তাহে মাত্র দুই দিন আসেন। প্রতিদিন নাগরিক সেবা পেতে অফিস-আফিস ঘুরতে হয়। স্থায়ী প্রশাসক থাকলে নাগরিকদের সময় ও শ্রম বাঁচবে।”
৮নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা ফিরোজ অভিযোগ করেন, “জেলেদের ভাতা নিয়মমতো দেওয়া হচ্ছে না। সরকারি কর্মকর্তারা একাধিক দায়িত্বে ব্যস্ত থাকায় মূল কাজ করতে পারছেন না। দশজনের কাজ এক জনের ওপর পড়লে যে ধীরগতি হয়, আমরা সেটাই অনুভব করছি।”
পৌরসভায় বর্তমানে ১৩ জনের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে মাত্র ছয়জনকে। এতে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, সমবায় অফিসার এবং অন্যান্য সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তার দায়িত্বও জড়িত। পৌরসভা কর্মচারী রবিউল জানান, “প্রতিদিনের কাজ ও শোনানি পরিচালনার জন্য আমাদের সীমিত সময় ও সংস্থান যথেষ্ট নয়। ইউএনও স্যার সপ্তাহে একদিন শোনানি কার্যক্রম পরিচালনা করেন, বাকি সময় আমাদেরই দায়িত্ব সামলাতে হয়। তবে তিনি যথেষ্ট চেষ্টা করেন কাজে সহযোগীতা করতে।”
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, “যেহেতু টেকনাফ পৌরসভা মাত্র এক কিলোমিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ, কাজ করা কিছুটা সহজ। তবে এতজন জনপ্রতিনিধির কাজ একসাথে করতে গেলে কিছুটা জটিলতা তো আছেই। প্রতিদিন আমি ২–৩ ঘণ্টা সময় দিই এবং সপ্তাহে একদিন শোনানি কার্যক্রম পরিচালনা করি।”
সরকার দেশের বিভিন্ন পৌরসভায় নতুন প্রশাসক নিয়োগের পরিকল্পনা করছে। এই পদক্ষেপের লক্ষ্য
স্থবির পৌর প্রশাসনে নতুন গতি আনা। যার মধ্যে নাগরিকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ বৃদ্ধি, চলমান উন্নয়ন প্রকল্প দ্রুত সম্পন্ন করা ও নাগরিক সেবা সহজতর করা।
এদিকে সারাদেশে নতুন প্রশাসক নিয়োগের খবরে সরব টেকনাফের রাজনীতি। পৌর সভার অভ্যন্তরে এখন প্রতিদিনই শোনা যাচ্ছে সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম। বিএনপি ও জামায়াতের দুই জনের নামই বারবার ঘুরে ফিরে আসছে আলোচনায়। কার ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত জুটবে ‘পৌর পিতা’র আসন, তা নিয়ে চলছে নানা জল্পনা।
পৌর বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি ও সাবেক প্যানেল মেয়র হাফেজ এনামুল হাছান বলেন,
“আমি স্থানীয় জনগণের দৈনন্দিন সমস্যা ভালোভাবে জানি। পৌরসভায় নাগরিক সেবা এখন অনেক সীমিত এবং কার্যক্রম ধীর। যদি আমি প্রশাসক হই, তাহলে নাগরিকদের সহজে সেবা পাওয়া নিশ্চিত করা হবে। আমরা ট্রেড লাইসেন্স, নাগরিক ভাতা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, রাস্তাঘাট মেরামত – সব কাজের প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবো।
সীমান্তবর্তী এলাকায় জেলেদের নিরাপত্তা এবং রোহিঙ্গা শিবিরের কারণে নাগরিকদের ভোগান্তি বাড়ছে। প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করলে এই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। আমি চাই, প্রত্যেক ওয়ার্ডে নাগরিকের অভিযোগ ও প্রয়োজন অনুযায়ী কার্যক্রম শুরু হবে। নাগরিকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা এবং তাদের সমস্যার দ্রুত সমাধান করা হবে। এছাড়া চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলিকে দ্রুত শেষ করে পৌরসভাকে আধুনিকায়ন করা আমার অন্যতম লক্ষ্য।”
অন্যদিকে, সাবেক ভারপ্রাপ্ত মেয়র ও টেকনাফ পৌর জামায়াতের সহ-সভাপতি মুহাম্মদ ইসমাইল বলেন,
“অনেকে আমাকে প্রশাসক হিসেবে দেখতে চান। আমি এখনও কোনো রাজনৈতিক তদবিরে লিপ্ত হইনি। তবে সুযোগ পেলে পৌরসভাকে সম্পূর্ণভাবে মাদকমুক্ত ও সামাজিকভাবে সুশৃঙ্খল করা আমার প্রধান লক্ষ্য।
৯টি ওয়ার্ডে যারা সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করবে, তাদের নিয়ে আমরা পৌর এলাকা গুছিয়ে তুলবো। হাসপাতাল এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে নাগরিকদের চিকিৎসা ও রোগ নির্ণয়ের সুযোগ সহজলভ্য হবে। এছাড়া পৌর তহবিল গঠন করে দরিদ্র ও অসহায় জেলে পরিবার এবং শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানো হবে।
আমি চাই, প্রশাসকের দায়িত্বে থাকলে প্রত্যেক নাগরিক যেন নিজের সমস্যা সহজে সমাধান করতে পারে। জনসেবাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেব এবং পৌরসভায় প্রতিটি প্রকল্পকে সময়মতো সম্পন্ন করবো। এই পদক্ষেপ স্থানীয় মানুষের ভোগান্তি ও হয়রানি কমাতে এবং প্রশাসনকে কার্যকর করতে সহায়ক হবে।”
পৌরসভা সংশোধন অধ্যাদেশ অনুযায়ী, সরকার বিশেষ পরিস্থিতিতে মেয়র ও কাউন্সিলরদের অপসারণ করে “উপযুক্ত ব্যক্তি” বা “সরকারি কর্মকর্তা”কে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দিতে পারে। ইতিমধ্যেই দেশের ৩৩০টি পৌরসভায় প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যমে প্রশাসক নিয়োগ এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে হয়নি।
টেকনাফ পৌরসভায় নাগরিক সেবা সংকট, প্রশাসনিক জটিলতা এবং নতুন প্রশাসক নিয়োগের জল্পনা এখনও চলমান। স্থানীয়দের আশা, প্রশাসক থাকলে নাগরিক সেবা দ্রুততর হবে, পৌরসভায় কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আসবে এবং চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হবে। সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপই নির্ধারণ করবে রাজনৈতিক নিয়োগ বাস্তবে রূপ নেবে কি না।