
বার্তা পরিবেশক :
কক্সবাজার সদর উপজেলার ঝিলংজা ইউনিয়নের দক্ষিণ ডিক্কুল এলাকা বর্তমানে এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একসময় নাপিত হিসেবে পরিচিত আব্দু সালাম এখন এই এলাকার মানুষের কাছে আতঙ্কের অপর নাম। স্থানীয়দের অভিযোগ, একসময় নাপিতের কাজ এবং পরে সিএনজি চালালেও মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে সে গড়ে তুলেছে একটি অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী বাহিনী। মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, হত্যা চেষ্টা, ধর্ষণ, অপহরণ, জমি দখলসহ নানান গুরুতর অপরাধে সে ও তার বাহিনী দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয়। তাদের দৌরাত্ম্যে জিম্মি হয়ে অতিষ্ঠ দক্ষিণ ডিক্কুলসহ আশপাশের এলাকার সাধারণ মানুষ।
অভিযোগ রয়েছে, আব্দু সালাম তার বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে দক্ষিণ ডিক্কুল পাহাড়ের গভীরে ইয়াবা ও অস্ত্রের আস্তানা তৈরি করেছে। বাহিনীর কাছে রয়েছে বিদেশি পিস্তল এবং ২৫ থেকে ৩০টি দেশীয় বন্দুক। এই অস্ত্রশস্ত্র তারা প্রকাশ্যে প্রদর্শন করে সাধারণ মানুষকে ভয় দেখিয়ে জমি দখল, মুক্তিপণ আদায়, চাঁদাবাজি ও ইয়াবা ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ নির্বিচারে চালিয়ে যাচ্ছে। প্রায়শই রাতের বেলায় তারা ফাঁকা গুলি ছুড়ে এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করে জনমনে ভীতির সঞ্চার ঘটায়।
রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ‘সমাজপতি’ সাজার চেষ্টা
সরেজমিনে দেখা গেছে, সন্ত্রাসী আব্দু সালাম দক্ষিণ ডিক্কুল পাহাড়ের ভেতরে গয়মতলী নামক এলাকায় মাহফিল আয়োজন করে ‘সমাজপতি’ সাজার চেষ্টা চালাচ্ছে। এই মাহফিলের ব্যানারে দেখা যায়, একদিকে মোটর চালক লীগের জেলা সভাপতি জানে আলম স্বপন, ২নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুল গফুরকে বিশেষ অতিথি করা হয়েছে, আবার অন্যদিকে প্রধান অতিথির নাম রয়েছে জামায়াতের এমপি প্রার্থী শহিদুল আলম বাহাদুর এবং বিশেষ অতিথির তালিকায় রয়েছে জেলা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক আমির আলী ও বিএনপি নেতা-পৌরসভার সাবেক প্যানেল মেয়র ওমর সিদ্দিক লালু। স্থানীয়রা বলছেন, আগে আওয়ামী লীগ নেতাদের ক্যাডার হিসেবে কাজ করলেও, এখন সে টাকার বিনিময়ে বিএনপি-জামায়াতের কুলে উঠার চেষ্টা করছে। মাহফিলের একজন বক্তা সওকত ওসমান নাকি কেলেংকারীর জন্য ঐ এলাকার মসজিদ থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন, যা নিয়েও স্থানীয়দের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
বর্বরতা ও গুরুতর অপরাধের ফিরিস্তি
আব্দু সালামের অপরাধের তালিকা দীর্ঘ। ২০১৮ সালে এক মাদক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে দুই লাখ পিচ ইয়াবা ছিনতাই করে সে আলোচনায় আসে। ২০২০ সালে নারী মাদক ব্যবসায়ী ফাতেমার কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকার ইয়াবা আত্মসাৎ করেও সে খবরের শিরোনাম হয়। শুধু তাই নয়, প্রবাসী আবু বক্কর তার ক্রয়কৃত জমিতে ভবন নির্মাণ করতে গেলে সালাম তার কাছে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। টাকা না দেওয়ায় সালাম বাহিনীর আক্রমণে রাম-দা দিয়ে কুপিয়ে আবু বক্করের হাত বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। ২০২৪ সালের ২৮ জুন কুতুবদিয়া পাড়ার যুবক ফয়সালকে উপজেলা বাজার থেকে অপহরণ করে গহীন পাহাড়ে নিয়ে যায় সালাম বাহিনী, যদিও পরে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। কিছুদিন পর, পুলিশকে সহযোগিতা করার অভিযোগ তুলে দানু মিয়া নামের স্থানীয় এক ব্যক্তির কাছ থেকেও চাঁদা দাবি করে তারা। টাকা না দেওয়ায় ২০২৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর রাতে ধারালো দা, হাতুড়ি ও হকিস্টিক দিয়ে মারধর করে তার হাত-পা ভেঙে দেওয়া হয়, যাঁর চিকিৎসা এখনও চলছে।
সালাম বাহিনী শুধু মাদক ও অপহরণের সঙ্গেই জড়িত নয়, জমি দখলেও তাদের দৌরাত্ম্য ব্যাপক। স্থানীয়দের অভিযোগ, শাহাজাহান মনির নামের এক শিক্ষকের বসতবাড়ির অর্ধেক জমি, নাজিম উদ্দিন নামের এক দিনমজুরের জমি, মৃত মৌলানা মোঃ আলীর জমির অংশ, প্রবাসী আবু নফরের জমিসহ অসংখ্য মানুষের সম্পত্তি দখল করে পরবর্তীতে বিক্রি করে দিয়েছে সালাম।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চ্যালেঞ্জ ও জনমনের দাবি
আব্দু সালামের বিরুদ্ধে কক্সবাজার সদর মডেল থানা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় ডজনখানেক মামলা রয়েছে। এর মধ্যে হত্যা চেষ্টা, চাঁদাবাজি, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, অপহরণ এবং জখমের মামলা উল্লেখযোগ্য। বারবার অভিযোগ উঠলেও সালাম ও তার বাহিনীকে ধরা সম্ভব হয়নি। কারণ পাহাড়ি এলাকায় তাদের আস্তানা থাকায় গোপন অভিযান চালিয়েও তাদের গ্রেপ্তার করা যায় না। তাছাড়া সালাম প্রকাশ্যে হুমকি দিয়ে বলে, যে কেউ তার বিরুদ্ধে মামলা করবে বা সাক্ষ্য দেবে তাকে হত্যা করা হবে। ফলে ভয়ে কেউ তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে সাহস পায় না।
স্থানীয়দের একটাই দাবি— দ্রুত আব্দু সালাম ও তার বাহিনীর ১০-১২ জন সক্রিয় সদস্যকে আইনের আওতায় এনে এলাকায় শান্তি ফিরিয়ে আনা হোক।
আব্দু সালামের বিরুদ্ধে কক্সবাজার সদর মডেল থানা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় ডজনখানেক মামলা রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— কক্সবাজার সদর মডেল থানা মামলা নং ৭, জি আর ২২৬/২১ (০৬-০৪-২০২১) ধারা ১৪৩/৪৪৭/৩২৩/৩২৪/৩২৫/৩২৬/৩০৭/১১৪/৫০৬(২)/১৪৯ দণ্ডবিধি;।
কক্সবাজার সদর মডেল থানা মামলা নং ৩১, জি আর ৯২/২১ (১০-০২-২০২১), ধারা ১৪৩/৪৪৭/৩২৩/৩৮৫/৩৭৯/৪২৭/৫০৬(২) চাঁদাবাজি মামলা;।
কক্সবাজার সদর মডেল থানা এফআইআর নং ৩৪/৮১৭ (০৯-০৮-২০১৭), ধারা ৪৪৭/৪৪৮/৩২৩/৩০৭/৩৭৯/৩৮২/৪২৭/৫০৬(২);।
এফআইআর নং ৬৯/৮০৩ (২১-০৮-২০১১), ধারা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯০ (ইয়াবা মামলা);।
কক্সবাজার সদর মডেল থানা মামলা নং ৬৫, জি আর ৩৭২/১৪ (২২-০৫-২০১৪), ধারা ১৪৩/৩৪১/৩২৩/৩২৫/৩২৬/৩০৭/৪৩৫/৪২৭; মামলা নং ১/৪৪৪ (০১-০৭-২০২৪), ধারা ১৪৩/১১৪/৩৬৫/৩৮৫/৩৮৬/৫০৬/৩৪;। জি আর ৬৪৭/২৪
চট্টগ্রাম পাঁচলাইশ মডেল থানা মামলা নং ২১/১৭৬ (২৩-০৭-২০২৪), ধারা ১২৩/৩২৩/৩২৪/৩২৫/৩২৬/৩০৭/২৭৯/৫০৬; এবং কক্সবাজার সদর মডেল থানা মামলা নং ১২/৬৪৭ (০৫-১০-২০২৪), ধারা ১৪৩/৩৪১/৩২৩/৩২৪/৩২৫/৩০৭/৩৮৫/১১৪/৫০৬।
