মো.কামরুল ইসলাম ফয়সাল ,রাঙামাটি
রাঙামাটিতে লাইন্সেস থেকে শুরু করে পরিবেশ ছাড়পত্র সহ কোনো অনুমোদন না থাকা সত্বেও অবৈধভাবে একের পর এক ইটভাটা নির্মাণ করা হচ্ছে। গত কয়েক বছর যাবৎ পার্বত্য জেলা গুলোতে ইটভাটার বিরুদ্ধে সরকারের নানান প্রদক্ষেপ গ্রহন ও ইট ভাটার জন্য কোনো ধরনের ছাড়পত্র না দিলেও রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে গত বছর ফাইভ স্টার নামে নতুন আরো একটি ইটভাটা নির্মাণ করা হয়েছে। কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির তৎপরতায় এসব ইটভাটা নির্মাণ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বাঘাইছড়ি উপজেলা সদরস্থ মারিশ্যা ইউনিয়নের তুলাবান—মুসলিম ব্লক সীমান্তে ফাইভ স্টার ব্রিকস নামের এই ইটভাটা তৈরি করা হয়। গত বছরের সেপ্টেম্বরে এই ইটভাটার নির্মাণকাজ শুরু হয়। এ নিয়ে বাঘাইছড়ি উপজেলা রয়েছে বর্তমানে ৩টি ইটভাটা।তবে কোনোটিতেই জেলা প্রশাসনের লাইন্সেস ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেওয়া হয়নি। বিভিন্ন সংগঠনের নেতার পরিচয়ে প্রকাশ্য পাহাড়ের মাটি কেটে পরিচালনা করা হচ্ছে এসব ইটভাটা।
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, ইটভাটা গুলো নির্মান করা হয়েছে আবাসিক এলাকার পাশে ফসলি জমি উপর। ইটভাটা গুলোতে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে কাঠ। চুল্লির আশপাশে স্তূপ করে রাখা হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ।
ইটভাটা গুলোতে ইট তৈরিতে আশপাশের পাহাড় থেকে শুরু করে ফসলি জমি কেটে সংগ্রহ করা হচ্ছে মাটি । ইটভাটার জ্বালানি হিসেবে কয়লা ব্যবহারের কথা থাকলেও জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে সংরক্ষিত ও গ্রামীণ বনের ছোট বড় গাছ। বিভিন্ন ফলদ বাগান থেকেও গাছ সংগ্রহ করা হচ্ছে। এতে এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ চরম হুমকির মধ্যে পড়েছে। ইটভাটার কারণে বায়ুদূষণ ঘটছে মারাত্মকভাবে। নষ্ট হচ্ছে ফসলি জমি। ধ্বংস হচ্ছে পাহাড় ও গাছপালা। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, পুরোনো পদ্ধতিতে ইট তৈরির কারণে মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে জনস্বাস্থ্যের। তারপরও বন্ধ হয়নি পরিবেশ বিধ্বংসী ইটভাটার কায্যক্রম।
এসব ইটভাটা গুলো উপজেলা সদরের এক কিলোমিটারের ভেতরে নির্মান করা হয়েছে। যার ফলে এর প্রভাব শুধু বনের উপর নই পড়েছে জনজীবনের উপরও। বাঘাইছড়ি উপজেলায় এমএমসি ইটভাটা টি উপজেলার সদরের চৌমুহনী মূল যে বাজার রয়েছে তার পাশেই অবস্থিত। যার ফলে ভাটা গুলোতে কাঠ পোড়ানো কালো ধোঁয়ায় জীবন অতিষ্ট করে তুলছে প্রতিনিয়ত। এমএমসি ইটের পর একই এলাকায় পাশাপাশি রয়েছে কেবিএম এবং ফাইভ স্টার নামে দুটি ইটভাটা। এসব ইট ভাটার বিষাক্ত কালো ধোঁয়ায় এবং নিকোটিনের ফলে স্থানীয়দের মাঝে প্রতিনিয়ত দেখা দিচ্ছে নতুন নতুন রোগ।
প্রশাসন ও পরিবেশবাদীদের আপত্তির পরও ইটভাটা গুলো পরিচালিত হয়ে আসছে দীর্ঘ দিন যাবৎ । এসব ইটভাটা গুলো প্রশাসনের নাকের ডগায় হলেও কোনো প্রদক্ষেপ নিচ্ছে না প্রশাসন। এদিকে ইটভাটা গুলোতে পরিচালনার ক্ষেত্রে একটিতেও পরিচালনা নিয়মের ছিটাফোঁটা ও দেখা মিলছে না। পোড়ানো হচ্ছে কাঠ, কাটা হচ্ছে পাহাড়, ফসলি জমি ও বাদ যাচ্ছে না এসব ইটভাটার ইট তৈরিতে মাটি যোগান দিতে। এসব অবৈধ কায্যক্রম গুলো চলছে দিনে—দুপুরে প্রশাসনের সামনেই। তবে পরিবেশ ধ্বংস কারী এসব চক্রের বিরুদ্ধে কেন নিরব প্রশাসন? ইটভাটা পরিচালনার অনুমতি সহ পরিচালনা বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে মুঠোফোনে কয়েকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও রিসিভ করেননি এই কর্মকর্তা।
ছাড়পত্র না থাকা, অবৈধভাবে ইটভাটা নির্মাণ সহ পরিবেশ ধ্বংস করে ইটভাটা পরিচালনার বিষয়ে ইটভাটার মালিকদের কাছে জানতে চাইলে মুঠোফোনে তারা বলেন, সরকারী উন্নয়ন মূলক কাজের জন্য আমরা ইটভাটা পরিচালনা করছি। এখানে ইট তৈরি না করলে সরকারের উন্নয়ন কাজ থেমে যাবে। আমরা সকলকে ম্যানেজ করে ইট তৈরি করছি। অন্যেরা যেমন সহযোগীতা করছে আমাদের আপনেরা সকলের মতো আমাদেরকে সহযোগীতা করবেন। আমরা দেখা করবো আপনার সাথে।
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ অনুযায়ী এসব ইটভাটা পরিচালিত হতে পারে না ।
আইন গুলো হচ্ছে,
১. লাইসেন্স ব্যতীত ইটভাটা স্থাপন ও ইট প্রস্তুত নিষিদ্ধ।
আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, ইটভাটা যে জেলায় অবস্থিত সেই জেলার জেলা প্রশাসকের নিকট হইতে লাইসেন্স গ্রহণ ব্যতিরেকে, কোনো ব্যক্তি ইটভাটা স্থাপন ও ইট প্রস্তুত করিতে পারিবে না :
২. মাটির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও হ্রাসকরণ।
(১) আপাতত বলবৎ অন্য আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, কোন ব্যক্তি ইট প্রস্তুত করিবার উদ্দেশ্যে কৃষিজমি বা পাহাড় বা টিলা হইতে মাটি কাটিয়া বা সংগ্রহ করিয়া ইটের কাঁচামাল হিসাবে উহা ব্যবহার করিতে পারিবেন না।
ইটভাটার লাইসেন্সের জন্য আবেদনপত্রে প্রস্তাবিত ইটভাটার মালিক কর্তৃক ইট প্রস্তুতের মাটির উৎস উল্লেখপূর্বক হলফনামা দাখিল করিতে হইবে।]
৩. জ্বালানী কাঠের ব্যবহার নিষিদ্ধ।
আপাতত বলবৎ অন্য কোন আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, কোন ব্যক্তি ইটভাটায় ইট পোড়ানোর কাজে জ্বালানি হিসাবে কোন জ্বালানি কাঠ ব্যবহার করিতে পারিবেন না।
৪. বর্জ্য নির্গমন ও গ্যাসীয় নিঃসরণের মানমাত্রা।
এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, ইটভাটা হইতে গ্যাসীয় নিঃসরণ ও তরল বর্জ্যের নির্গমন মাত্রা পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা, ১৯৯৭ এ উল্লিখিত মানমাত্রার মধ্যে থাকিতে হইবে।]
৫. কতিপয় স্থানে ইটভাটা স্থাপন নিষিদ্ধকরণ ও নিয়ন্ত্রণ।
(১) আপাতত বলবৎ অন্য কোন আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, ছাড়পত্র থাকুক বা না থাকুক, এই আইন কায্যকর হইবার পর নিম্নবর্ণিত এলাকার সীমানার অভ্যন্তরে কোন ব্যক্তি কোন ইটভাটা স্থাপন করিতে পারিবেন না, যথাঃ—
(ক) আবাসিক, সংরক্ষিত বা বাণিজ্যেক এলাকা;
(খ) সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা বা উপজেলা সদর;
(গ) সরকারি বা ব্যক্তি মালিকানাধীন বন, অভয়ারণ্য, বাগান বা জলাভূমি;
(ঘ) কৃষি জমি;
(ঙ) প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা;
(চ) ডিগ্রেডেড এয়ার শেড (উবমৎধফবফ অরৎ ঝযবফ)।
(২) এই আইন কায্যকর হইবার পর, নিষিদ্ধ এলাকার সীমানার অভ্যন্তরে ইটভাটা স্থাপনের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর, বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষ কোন আইনের অধীন কোনরূপ অনুমতি বা ছাড়পত্র বা লাইসেন্স, যে নামেই অভিহিত হউক, প্রদান করিতে পারিবে না।
(৩) ১৭[ ***] কোন ব্যক্তি নিম্নবর্ণিত দূরত্বে বা স্থানে ইটভাটা স্থাপন করিতে পারিবেন না, যথাঃ—
(ক) নিষিদ্ধ এলাকার সীমারেখা হইতে ন্যূনতম ১ (এক) কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে;
(খ) ১৮[ ***] সরকারি বনাঞ্চলের সীমারেখা হইতে ২ (দুই) কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে;
(গ) কোন পাহাড় বা টিলার উপরিভাগে বা ঢালে বা তৎসংলগ্ন সমতলে কোন ইটভাটা স্থাপনের ক্ষেত্রে উক্ত পাহাড় বা টিলার পাদদেশ হইতে কমপক্ষে ১/২(অর্ধ) কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে;
(ঘ) পার্বত্য জেলায় ইটভাটা স্থাপনের ক্ষেত্রে, পার্বত্য জেলার পরিবেশ উন্নয়ন কমিটি কর্তৃক নির্ধারিত স্থান ব্যতীত অন্য কোন স্থানে;
(ঙ) বিশেষ কোন স্থাপনা, রেলপথ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও ক্লিনিক, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বা অনুরূপ কোন স্থান বা প্রতিষ্ঠান হইতে কমপক্ষে ১ (এক) কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে।
(ক) “আবাসিক এলাকা” অর্থ এমন কোন এলাকা যেখানে কমপক্ষে ৫০ (পঞ্চাশ) টি পরিবার বসবাস করে;
(গ) “প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা” অর্থ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ধারা ৫ এর অধীন ঘোষিত কোন এলাকা;
(ঙ) “ব্যক্তিমালিকানাধীন বন” অর্থ এমন কোন বন যাহা বন অধিদপ্তর কর্তৃক ব্যক্তি মালিকানাধীন বন হিসাবে স্বীকৃত এবং যাহার গাছপালার আচ্ছাদন বনের কমপক্ষে ৩০ (ত্রিশ) ভাগ এলাকায় বিস্তৃত থাকে, এবং সামাজিক বন বা গ্রামীণ বনও উহার অন্তর্ভুক্ত হইবে।
ইটভাটা আইনে এসকল বিষয়ে স্পষ্ট উল্লেখ থাকলেও বাঘাইছড়িতে স্থাপিত ইটভাটা গুলোতে এসব বিধিবিধানের কোনো কিছুই নেই। বলা যায় প্রচলিত আইনকে বৃদ্ধ আঙ্গুল দেখিয়ে বাঁধাহীন ভাবেই দিনের পর দিন পরিচালনা করে আসছে এসব ইটভাটা।
এদিকে পার্বত্য তিন জেলার বিভিন্ন স্থানে থাকা অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম যাতে শুরু না করতে পারে সে ব্যাপারে আগামী ১ সাপ্তাহের মধ্যে জেলা প্রশাসকদের পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ প্রদান করেছেন হাইকোর্ট।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ।
গত ০৫/০১/২০২৫ ইং তারিখে
বিচারপতি ফারাহ মাহবুব এবং বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর আদালতে বিষয়টির উপর শুনানি হয়। শুনানি শেষে আদালত আদেশ প্রদান করেন যে, ১ সপ্তাহের মধ্যে জেলা প্রশাসক নিজ নিজ এলাকার অবৈধ ইটভাটার মালিকরা যাতে তাদের কার্যক্রম শুরু না করতে পারে সে বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং উক্ত কার্যক্রম সম্পর্কে আগামি ২ সাপ্তাহের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করবে।