প্রিন্ট এর তারিখঃ ডিসেম্বর ১, ২০২৫, ১২:৪১ এ.এম || প্রকাশের তারিখঃ অক্টোবর ১২, ২০২৫, ৪:৫০ অপরাহ্ণ
শিক্ষার্থীদের কণ্ঠে চাকসু: অধিকার আদায়ের নতুন প্ল্যাটফর্ম
রাহুল হাসান, (ক্যাম্পাস প্রতিনিধি)
দীর্ঘ ৩৬ বছর পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু ) নির্বাচন। এ নির্বাচনকে ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এখন উৎসবমুখর, এমন প্রাণবন্ত আমেজ আগে কখনো দেখা যায়নি বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের মতে, চাকসু হতে হবে একটি নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান যেখানে সবকিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে প্রতিনিধিরা শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কাজ করবেন। তারা এমন প্রার্থীকে বেছে নিতে চান, যিনি মেধাবী, স্বচ্ছ ও শিক্ষার্থীবান্ধব নেতৃত্বগুণসম্পন্ন। বিশেষ করে যারা শিক্ষাবান্ধব কর্মসূচি বাস্তবায়ন, ন্যায্য দাবি আদায়ে আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় থেকেছেন।
চাকসু নিয়ে নিজের প্রত্যাশার কথা জানান উদ্ভিদ বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী শিহাব উদ্দিন। তিনি বলেন,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ ৩৬ বছর পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে চাকসু নির্বাচন। এই নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিনিধি পাব,যারা আমাদের অধিকার আদায়ে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। আবাসন সংকট ও দুর্বল যোগাযোগব্যবস্থাকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখে শিক্ষার্থীরা চান, প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে এসব সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা হোক। প্রার্থীদের ইশতেহার হতে হবে বাস্তবায়নযোগ্য, সময়োপযোগী ও শিক্ষার্থীদের চাহিদাভিত্তিক। ভোটারদের আস্থা অর্জনে প্রার্থীদের স্বচ্ছ প্রতিশ্রুতি জরুরি।এছাড়া শিক্ষার্থীরা বিশ্বাস করেন, কেবল যোগ্য ও প্রতিশ্রুতিশীল নেতৃত্বই তাঁদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পূরণ করতে সক্ষম হবে।
দর্শন বিভাগের ফারিহা নানজিবা বলেন,চাকসুকে শিক্ষার্থীরা গণতান্ত্রিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দেখলেও এর কার্যকারিতা নির্ভর করছে নির্বাচনের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সক্রিয়তার ওপর। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা শুধু প্রতিশ্রুতিতে সীমাবদ্ধ না থেকে বাস্তবায়নে কাজ করবেন এবং দলীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে সবার প্রতিনিধিত্ব করবেন বলে মনে করি। পরিবহন ব্যবস্থা উন্নয়ন, আবাসন সমস্যা সমাধান, নিরাপত্তা জোরদার ও জরুরি সেবা নিশ্চিত করার পাশাপাশি শিক্ষার্থী-শিক্ষক সংলাপ ও আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানাই। নারী ও প্রান্তিক শিক্ষার্থীদের সমান মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং ভয়-ভীতিমুক্ত মুক্ত মতপ্রকাশের পরিবেশ তৈরিই এখন শিক্ষার্থীদের প্রধান প্রত্যাশা।
বিশ্ববিদ্যালয় হলের ডাইনিং ও ক্যান্টিন গুলোর খাবারের পুষ্টিগত মান খুবই কম এ বলে মন্তব্য করেন শিক্ষার্থীরা। ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থী খলিলুর রহমান বলেন, প্রধান দাবি নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ। তাঁর অভিযোগ, ডাইনিংয়ের খাবারে পুষ্টির অভাবে প্রতিদিন প্রায় ২০০ শিক্ষার্থী চিকিৎসা নিতে বাধ্য হন।শাটল ট্রেনের ভোগান্তি নিরসন, পরিবেশবান্ধব যানবাহন বৃদ্ধি এবং নারী শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ ক্যাম্পাস নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন তিনি।
ইতিহাস বিভাগের রাজিয়া সুলতানা জাহিন নারীবান্ধব ক্যাম্পাস নির্মাণের দাবি জানান।তিনি মনে করেন,ক্যাম্পাসে সিসিটিভি, নিয়মিত নিরাপত্তা টহল, বহিরাগত প্রবেশ নিষিদ্ধকরণ ও জরুরি সহায়তা সেবা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার্থী-শিক্ষক সংলাপ, টিএসসি বাস্তবায়ন, নারী ও প্রান্তিক শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা এবং স্বাধীন মতপ্রকাশের পরিবেশ নিশ্চিত করাকে শিক্ষার্থীরা অপরিহার্য মনে করছেন বলেও জানান তিনি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী মং শাই সোয়ে মারমা বলেন,ক্যাম্পাসটি এখনো শিক্ষকবান্ধব, অথচ এটি হওয়া উচিত শিক্ষার্থী-বান্ধব। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা এই প্রথার পরিবর্তন ঘটিয়ে ক্যাম্পাসকে সত্যিকার অর্থে শিক্ষার্থীদের জন্য উপযোগী করে তুলবেন বলে প্রত্যাশী ক্লাব ও সংগঠনগুলোর কার্যক্রম সমন্বয়ের অভাবে থমকে আছে, যা সমাধানে উদ্যোগ প্রয়োজন। সবচেয়ে বড় সংকট আবাসন—পরিত্যক্ত হল সংস্কার এবং শিক্ষার্থীদের জন্য নির্দিষ্ট বাস শিডিউল বরাদ্দ করলে ভোগান্তি অনেকটা কমবে বলে মনে করেন তিনি। পাশাপাশি শাটল ট্রেন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করাও জরুরি। পাহাড়ি ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা সমান অধিকার ও সংস্কৃতির প্রতি সম্মান প্রত্যাশা করেন।
মেরিন সাইন্সের শিক্ষার্থী হাসিন আহাদাব মনে করেন,সেশনজট তাঁদের শিক্ষাজীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যা, যা সমাধানে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রশাসনকে কার্যকর পদক্ষেপে বাধ্য করতে হবে। একই সঙ্গে যত্রতত্র আবর্জনা ফেলা বন্ধ, নির্দিষ্ট ডাস্টবিন ও পর্যাপ্ত ওয়াশরুম স্থাপন, প্রশাসনিক কাজে ডিজিটালাইজেশন এবং বাস্তবায়নযোগ্য ইশতেহারের দাবি তোলেন। শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা, চাকসু নির্বাচন শুধু প্রতিনিধি বাছাই নয়, বরং দীর্ঘদিনের সমস্যার সমাধানের নতুন সুযোগ হয়ে উঠবে এবং যোগ্য নেতৃত্ব মৌলিক অধিকার রক্ষায় ভূমিকা রাখবে।
মৃত্তিকা বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী রাজিয়া সুলতানা রাকা বলেন,পরবর্তী বছর আমাদের ক্যাম্পাসের পরিবেশ কেমন হবে, তা অনেকটাই চাকসুর ওপর নির্ভর করবে। তাই ক্লাসরুম, গ্রন্থাগার, আবাসিক হল—যেকোনো সমস্যা সমাধানে শিক্ষার্থীরা যেন একটি একক প্ল্যাটফর্ম পায়। আমার প্রত্যাশা নির্বাচিত প্রার্থীদের পড়াশোনার পরিবেশ উন্নত করা, সঠিক সময়ে ক্লাস ও পরীক্ষার ব্যবস্থা করা, নিরাপত্তা বাড়ানো, হলের সুযোগ-সুবিধা উন্নত করা এবং যেকোনো প্রয়োজনে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানো প্রতিনিধিদের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বাড়াতে ক্যাম্পাসে বিভিন্ন ক্লাব বা সংগঠনের ভূমিকা জরুরি। বইপড়া, ভাষা শেখার ক্লাব, এমনকি মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক ক্লাব তৈরির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে।
বিজয়-হলের আবাসিক শিক্ষার্থী সারা চৌধুরি মনে করেন,নির্বাচনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা এমন একজন প্রতিনিধি পাবেন, যিনি ২৫ হাজার শিক্ষার্থীর মুখপাত্র হয়ে সামগ্রিক স্বার্থ তুলে ধরবেন। এই প্রতিনিধি হতে হবে অভিজ্ঞ, সৎ, সাহসী ও নির্লজ্জ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত। কার্যকর চাকসু গঠিত হলে শিক্ষার্থীদের দাবি সহজে প্রশাসনের কাছে পৌঁছাবে, দীর্ঘদিনের সমস্যা সমাধান নিরসন হবে এবং শিক্ষা-গবেষণার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি হবে।
উল্লেখ, ১৫ ই আগস্ট চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ নির্বাচনে ২৭ হাজার শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করবেন।
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত