প্রিন্ট এর তারিখঃ সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২৫, ৮:৩১ এ.এম || প্রকাশের তারিখঃ সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৫, ১১:১১ পূর্বাহ্ণ
হেফাজতকে কাছে পেতে তৎপর বিএনপি
চিটাগং ট্রিবিউন ডেস্ক
অরাজনৈতিক সংগঠন হলেও আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামকে কাছে পেতে তৎপরতা শুরু হয়েছে রাজনীতিতে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনসহ ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দলের নির্বাচনী সমঝোতা করতে যাচ্ছে। এখানে কয়েকটি দল আছে হেফাজতে ইসলাম-সংশ্লিষ্ট। তারা অভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে।
এমন পটভূমিতে নির্বাচন সামনে রেখে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠনটির শীর্ষ নেতৃত্ব বিএনপির কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ইতিমধ্যে হেফাজতের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে বিএনপি যোগাযোগও বাড়িয়েছে। আবার হেফাজতের আমিরও এর মধ্যে কয়েকটি বক্তব্যে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে কথা বলেছেন।
সব মিলিয়ে কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক ‘ভোটব্যাংক’ লক্ষ্য করে রাজনৈতিক দলগুলোর হেফাজতকেন্দ্রিক আগ্রহ বেড়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় হেফাজতের আমির মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এর আগে গত ১ আগস্ট বিএনপির দুই নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ ও নজরুল ইসলাম খান চট্টগ্রামে গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন।
হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ চার নেতা ‘আল্লামা শাহ আহমাদ শফী, আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী, আল্লামা নূর হুসাইন কাসেমী ও আল্লামা নূরুল ইসলাম জিহাদীর নেতৃত্ব, ত্যাগ ও সংগ্রাম’ শীর্ষক জাতীয় কনফারেন্সে বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। গত শনিবার জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে
এদিকে জামায়াতে ইসলামীসহ যে সাতটি দল জুলাই সনদের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এবং সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচনসহ বিভিন্ন দাবিতে অভিন্ন কর্মসূচি শুরু করেছে, এর মধ্যে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক দল রয়েছে পাঁচটি। সেগুলো হলো ইসলামী আন্দোলন (সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম) বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস (মামুনুল হক), খেলাফত মজলিস (আবদুল বাসেত-কাদের), বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন (হাবিবুল্লাহ মিয়াজী) ও নেজামে ইসলাম পার্টি (সারওয়ার কামাল-মূছা বিন ইযহার)। এর মধ্যে ইসলামী আন্দোলন ছাড়া বাকি চারটি দলের হেফাজতের সঙ্গে যুক্ততা রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, হেফাজতে ইসলামের আমির মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী চান না, কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক কোনো দল জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনী জোট বাঁধুক। বাবুনগরী শুরু থেকেই জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে, দলটির প্রতিষ্ঠাতা সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদুদীর বিশ্বাসগত আদর্শিক কারণে।
গত কয়েক মাসে মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীকে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে একাধিক বক্তব্য দিতে দেখা যায়। তিনি গত জুলাই মাসে এক অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামী ‘সহিহ ইসলামী দল নয়’ বলে মন্তব্য করেন। বাবুনগরী বলেন, জামায়াত মদিনার ইসলাম নয় বরং মওদুদীর ইসলাম কায়েম করতে চায়। মওদুদীর মতাদর্শ অনুসরণ করলে ইমান থাকবে না।
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার, যেদিন জামায়াতসহ সাতটি দল একযোগে বিক্ষোভ সমাবেশের কর্মসূচি করছে, সেদিন সকালেই ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ‘জাতীয় উলামা মাশায়েখ সম্মেলন ২০২৫’-এ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী বক্তৃতা করেন। সেখানে তিনি জামায়াতের সঙ্গে ইসলামি দলগুলোর জোট বাঁধার বিপক্ষে কথা বলেন। তিনি সেই দলগুলোর উদ্দেশে বলেন, আগামী নির্বাচনে এমন কোনো দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার চিন্তা করা যাবে না, যাদের ভ্রান্ত বিশ্বাস সম্পর্কে বুজুর্গানে দ্বীন ও পূর্বপুরুষেরা আগেই সতর্ক করেছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হেফাজতের আমিরের এই অবস্থান বর্তমান সময়ে বিএনপির জন্য বেশ সহায়ক। বিশেষ করে জামায়াতের সঙ্গে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক পাঁচটি দলের একযোগে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি দাবিতে কর্মসূচি শুরুর পটভূমিতে।
তবে মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর এমন বক্তব্যকে হেফাজতে ইসলামের নয়, সংগঠনের আমিরের ব্যক্তিগত বক্তব্য বলে মনে করেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘হেফাজতের আমির একজন বুজুর্গ ও বিজ্ঞ আলেম। আমরা ওনাকে সম্মান করি। ইসলামি দলগুলোর ঐক্যের ব্যাপারে ইসলামি উম্মাহর সবাই আন্তরিক। সেখানে ঐক্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, এমন কথা তিনি বলতে পারেন না। এ ধরনের বক্তব্য কোনো খালেস মোমিনের (খাঁটি মোমিন) কাছ থেকে কাম্য নয়।’
অবশ্য হেফাজতে ইসলামীর আমিরের জামায়াতবিরোধী ধারাবাহিক এমন বক্তব্য নিয়ে সংগঠনের ভেতরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। বিশেষ করে ধর্মভিত্তিক কোনো অরাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃত্বে থেকে এভাবে কোনো রাজনৈতিক দলকে আক্রমণ করে বক্তব্য দেওয়া বা নির্বাচনী জোট গঠনের বিরোধিতা করে কথা বলতে পারেন কি না, এ নিয়ে হেফাজতের ভেতরে কিছু কথাবার্তা হচ্ছে। তবে হেফাজতের আমির দেশের একজন বয়োজ্যেষ্ঠ আলেম, তিনি কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি। তাই তাঁর বক্তব্য নিয়ে ভিন্নমত থাকলেও কেউ প্রকাশ্যে বিরোধিতা করছেন না।
এ বিষয়ে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক একটি দলের নায়েবে আমির নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমিরের (মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী) বক্তব্য নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে দুই মতই আছে। উনি মুরব্বি মানুষ, তাই কেউ প্রতিক্রিয়া জানাবে না।’
ইসলামপন্থী একটি দলের দায়িত্বশীল এক নেতা জানান, মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী একসময় প্রয়াত মুফতি ফজলুল হক আমিনীর নেতৃত্বাধীন ইসলামী ঐক্য জোটের অন্যতম উপদেষ্টা ছিলেন। আমিনীর মৃত্যুর পর ২০১৬ সালের দলের সম্মেলনে তাঁকে দলের জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান করা হয়েছিল। তখন ইসলামী ঐক্যজোট বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের শরিক দল ছিল। জামায়াতে ইসলামী সেই জোটের অন্যতম প্রধান শরিক দল ছিল। ওই সময়ে তাঁকে জামায়াতের বিরুদ্ধে কথা বলতে দেখা যায়নি।
২০১৬ সালে ইসলামী ঐক্যজোট বিএনপির জোট ছেড়ে যায়। মুফতি আমিনীর ছেলে আবুল হাসানাত আমিনীর নেতৃত্বে দলটি আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে সখ্য রেখে চলে। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর হাসানাত আমিনীসহ অন্যরা গা ঢাকা দেন। এখন দল পুনর্গঠন করে নিজের নামে ইসলামী ঐক্যজোটের নিবন্ধন নিতে চাইছেন মুফতি আমিনীর জামাতা সাখাওয়াত হোসাইন রাজী। এ নিয়ে হাসানাত আমিনীর সঙ্গে তাঁর বিরোধ চলছে।
ইসলামপন্থী দলগুলোর কোনো কোনো নেতা বলছেন, নির্বাচন সামনে রেখে হেফাজতে ইসলামকে ব্যবহার করতে চাইছে বিএনপি। এ কারণে বিএনপির নেতারা তাঁর সঙ্গে বারবার দেখাসাক্ষাৎ করছেন।
অবশ্য বিএনপির নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘হেফাজতে ইসলামের আমির রাজনীতি করেন না। তিনি বিখ্যাত আলেম এবং মুরব্বি মানুষ। আমি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দোয়া চাইতে গিয়েছিলাম। এর বেশি কিছু নয়।’
হেফাজতে ইসলাম-সংশ্লিষ্ট দলগুলোর মধ্যে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, নেজামে ইসলাম পার্টি ও ইসলামী ঐক্যজোটের ছোট একটি অংশ বিএনপির সঙ্গে আছে। এর মধ্যে জমিয়ত সবচেয়ে পুরোনো রাজনৈতিক দল। হেফাজতে ইসলামে এ দলটির প্রভাব রয়েছে। দলটির উল্লেখযোগ্য নেতা হেফাজতের কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। জমিয়তের একাধিক নেতা বিএনপির মনোনয়নে প্রার্থী হতে চাইছেন বলে জানা গেছে।
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত