আওয়ামী মাফিয়ার ছায়ায় বেড়ে ওঠা, এখন বিএনপি -জামায়াত পরিচয়ে রেলওয়ে টেন্ডার দখল

বিশেষ প্রতিবেদক
বাংলাদেশ রেলওয়ের টেন্ডার খাত বছরের পর বছর ধরে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে এক ভয়ঙ্কর সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। নাম মাত্র “রেলওয়ে কন্ট্রাক্টরস অ্যাসোসিয়েশন”, বাস্তবে এটি এখন টেন্ডার বাণিজ্যের গোপন কারখানা। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে রয়েছেন সিরাজগঞ্জের শফিকুর রহমান স্বপন ও নাঙ্গলকোটের শাহ আলম।
অভিযোগ রয়েছে, কমিশন ছাড়া কোনো টেন্ডারই রেলওয়ের ভেতরে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। কাজের পরিমাণ যাই হোক, ১০ শতাংশ বাধ্যতামূলক। না দিলে কাজ বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি, অকথ্য ভাষায় গালাগাল কিংবা কিশোর গ্যাং দিয়ে হামলার মতো ঘটনা ঘটানো হয়। কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে সাধারণ ঠিকাদার সবাই তাদের দাপটে অতিষ্ঠ।
রেলওয়ের একাধিক ঠিকাদার অভিযোগ করে জানান, টেন্ডার জেতার পরও কমিশন ছাড়া কাজ চালানো যায় না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ঠিকাদার বলেন,”টেন্ডার জিতেও আমরা প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন নই। ফোন করে কমিশন দাবি করা হয়। অস্বীকৃতি জানালে গালাগাল থেকে শুরু করে হামলার ভয় দেখানো হয়।”
গোপন তথ্যে জানা গেছে, এই চাঁদাবাজির অন্তত ২৫ শতাংশ ভাগ চলে যায় ভারতে পালিয়ে থাকা যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবরের কাছে।
চট্টগ্রামের কুখ্যাত যুবলীগ নেতা বাবর একসময় রেলওয়ের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতেন সরাসরি। বছরে প্রায় হাজার কোটি টাকার টেন্ডার নিয়ন্ত্রণে ছিল তার দখল। হত্যা, অস্ত্র, মাদক ও চাঁদাবাজির অসংখ্য মামলার আসামি বাবরকে বলা হতো রেলওয়ে টেন্ডারবাজির সম্রাট।
২০২৪ সালের কোটা আন্দোলনে প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে হামলার নেতৃত্ব দিয়ে আলোচনায় আসেন বাবর। পরে ভারত পালিয়ে গেলেও তার প্রভাব কমেনি। তার ছত্রচ্ছায়ায় বেড়ে ওঠা স্বপন ও শাহ আলম এখনো সেই সাম্রাজ্য ধরে রেখেছেন।
৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর স্বপন-শাহ আলম জুটি হঠাৎই নিজেদের বিএনপি পরিচয়ে হাজির হন। বিএনপির মহানগরের যুগ্ম আহ্বায়ক শওকত আজম খাজার নাম ভাঙিয়ে তারা শত শত কোটি টাকার টেন্ডার নিজেদের প্রতিষ্ঠানের নামে নিয়েছেন।
শাহ আলমের মালিকানাধীন এসএ করপোরেশন ও ইউনিক ট্রেডার্স সবচেয়ে বেশি কাজ পাচ্ছে। কক্সবাজার থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত অন্তত ২০০ রেলওয়ে ক্যান্টিন রয়েছে তার নিয়ন্ত্রণে। চট্টগ্রামের সিআরবি ও অন্যান্য জায়গায় একাধিক সম্পদও তার দখলে।
অন্যদিকে আহ্বায়ক শফিকুর রহমান স্বপনও রেলওয়ে ট্রেনিং একাডেমির দিঘি দখলসহ নানা অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন। তাদের সহযোগী হিসেবে মাঠে সক্রিয় রয়েছেন পিচ্ছি হেলাল, ইউনুস মুন্না, পিন্টু, মিন্টু ওরফে টেনশন মিন্টু, ঘাড় বাঁকা আনোয়ার, স্বেচ্ছাসেবক দলের রাজু, মামুন কোরেশী ও মাষ্টার আরিফ প্রমুখ।
রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল চট্টগ্রামের সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং (সিআরবি) হয়ে উঠেছে এই টেন্ডার বাণিজ্যের সদর দপ্তর। রেলওয়ের এক কর্মকর্তা বলেন,
“দেড় দশক ধরে একই গোষ্ঠীর হাতে কাজ যাচ্ছে। কমিশন ছাড়া কোনো প্রকল্প শুরুই হয় না। আমরা বাধ্য হয়ে তাদের চাপ মানি।”
অভিযোগ রয়েছে, রেলওয়ের বছরে হাজার কোটি টাকার টেন্ডার সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। কমিশন থেকে শুরু করে ঠিকাদারি ভাগাভাগি-সবই ঠিক হয় স্বপন-শাহ আলম জুটির কক্ষে বসে। এমনকি কিশোর গ্যাং ব্যবহার করে তারা ভয়ভীতি প্রদর্শন করে থাকে।
রেলওয়ের সাধারণ ঠিকাদার, কর্মকর্তা এবং ভুক্তভোগী জনগণের দাবি-“এ সিন্ডিকেট ভেঙে রেলওয়ের টেন্ডার ব্যবস্থাকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করা হোক। নইলে দেশের অন্যতম বৃহৎ এই খাত পুরোপুরি লুটপাটের কবলে চলে যাবে।”