সোমবার, ডিসেম্বর ১, ২০২৫

ইউএনও নীলুফার অনন্য মানবিকতা,লাল পরী হয়ে মরিয়মের ঘরে ফেরা

উম্মে হাবিবা শিরু
সন্ধ্যা ছয়টা পেরিয়ে কিছুক্ষণ হলো। তখনো পুরোপুরি রাত নামেনি। অফিসে তখনো নিত্যদিনের মতো ব্যস্ততা। এমন সময় কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নীলুফা ইয়াসমিনের অফিসে এক স্টাফ খালি পায়ে, সবুজ জামা পরা এক ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে ঢুকলেন। জানালেন, এক ব্যক্তি মেয়েটিকে অফিসে দিয়ে গেছেন। বলেছিলেন, বাস টার্মিনাল থেকে মেয়েটিকে পেয়েছেন। হারিয়ে গেছে সে।
অফিসে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির মুখে ভয়ার্ত ছাপ, চোখে জল। ইউএনও নীলুফা ইয়াসমিন কাছে ডেকে মেয়েটির সঙ্গে কথা বললেন। কান্নারত কণ্ঠে মেয়েটি জানায়, তার নাম মরিয়ম, বয়স আট বছর। চোখে ভালো দেখতে পায় না। থাকে এক মাদ্রাসায়, সেখানেই পড়ে। সেদিন মাদ্রাসা থেকে ছুটি দেওয়া হয়, কিন্তু তার মা তাকে নিতে আসতে পারেননি। এক লোক বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে মাদ্রাসার সামনে থেকে নিয়ে আসে কক্সবাজার বাস টার্মিনালে। তারপর থেকে কিছুই জানে না। শুধু এটুকু জানে, সে পথ হারিয়ে ফেলেছে।
মানবিক এক উদ্যোগ-
মরিয়মের সঙ্গে কথা বলে ইউএনও নীলুফা ইয়াসমিন জানতে পারেন, তার বাবা মারা গেছেন, মা অন্ধ, বড় ভাইও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। এক বোন আছে, যিনি অষ্টম শ্রেণিতে পড়েন। সে-ই সংসার সামলান। সরকারি সহায়তায় একটি ঘর পেয়েছেন মরিয়মের মা, পান অন্ধভাতাও।
এই তথ্যগুলো একত্র করে ইউএনও বুঝতে পারেন, মেয়েটির বাড়ি সম্ভবত কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার পোকখালী এলাকায়। সঙ্গে সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করেন ঈদগাঁও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সমাজসেবা কর্মকর্তা এবং স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে। প্রতিবন্ধীদের সরকারি তালিকা ঘেঁটে খোঁজ শুরু হয় মরিয়মের পরিবারের। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাওয়া যায় তার মায়ের ঠিকানা।
ততক্ষণে রাত নেমে এসেছে। ইউএনও নীলুফা ইয়াসমিন নিজেই ফোনে কথা বলেন মরিয়মের মায়ের সঙ্গে। কণ্ঠে কেঁপে ওঠা আবেগ, হারানো মেয়েকে ফিরে পাওয়ার আশায় মায়ের চোখে জল। সঙ্গে সঙ্গেই গ্রাম পুলিশ ও এক প্রতিবেশীকে নিয়ে রওনা হন মেয়েকে নিতে।
মায়ের অপেক্ষায় ইউএনও নীলুফার সঙ্গে থাকার সময়টুকুতে মরিয়ম জানায়, ছোটবেলায় চোখে অনেক ভালো দেখত। কিন্তু টাকার অভাবে কখনো চিকিৎসা হয়নি। ইউএনও নীলুফা ইয়াসমিন বিষয়টি শুনে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেন। উপস্থিত সমাজকর্মী সুজন ও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রাসেলকে নিয়ে যোগাযোগ করেন কক্সবাজার কমিউনিটি চক্ষু হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. বিমল চৌধুরীর সঙ্গে। অল্প সময়ের মধ্যেই মরিয়মকে নিয়ে যাওয়া হয় ডাক্তারের চেম্বারে। মানবিক এই চিকিৎসক বিনা ফিতে চোখ পরীক্ষা করেন এবং পাওয়ার অনুযায়ী চশমা দেন। চিকিৎসকের পরামর্শে আরও উন্নত চিকিৎসার জন্য মরিয়মকে রেফার করা হয়। চশমা পরে মরিয়মের মুখে ফুটে ওঠে এক চিলতে হাসি। বলে, “এখন আগের চেয়ে কিছুটা ভালো দেখি।” সেই হাসি যেন অফিসকক্ষের অন্ধকার ঘরে সূর্যরশ্মি এনে দিল।
স্বপ্ন ‘লাল পরী’ হওয়ার-
মেয়েটিকে খালি পায়ে বাড়ি ফেরানো ঠিক হবে না, ভাবলেন ইউএনও নীলুফা ইয়াসমিন। তাই মরিয়মকে নিয়ে যাওয়া হলো বাজারে। প্রথমেই কেনা হলো এক জোড়া সবুজ জুতো। জানতে চাওয়া হলো, তার প্রিয় রং কী? সে মিষ্টি হেসে বলে, “হলুদ।” তাকে একটি হলুদ জামা উপহার দেওয়া হলে সে বলে ওঠে, “আমি লাল পরী হতে চাই… লাল জামা, লাল চুড়ি, লাল লিপস্টিক, আর মাদ্রাসায় পড়ি তাই লাল ওড়নাও লাগবে!”
তার ইচ্ছা পূরণে ইউএনও নীলুফা ইয়াসমিন নিজেই নিয়ে গেলেন মেয়েটিকে কক্সবাজারের মেগামার্ট শপিং মলে। দোকানে ঢুকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে দেখে সাজানো পুতুলগুলোকে। নিষ্পাপ কণ্ঠে প্রশ্ন করে, “এরা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে কেমন করে?”
অবশেষে তার পছন্দে কেনা হয় একগুচ্ছ লাল পোশাক। লাল ফ্রক, লাল চুড়ি, লাল ওড়না, লাল লিপস্টিক। মুহূর্তেই সে যেন সত্যি সত্যি ‘লাল পরী’ হয়ে ওঠে।
অন্ধ মায়ের কোলে ফেরা-
এ সময়ই অফিসে পৌঁছে যান মরিয়মের মা, বোন ও গ্রাম পুলিশ। অফিসকক্ষে ঢুকেই মরিয়ম ছুটে গিয়ে মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অন্ধ মায়ের চোখে তখন মেয়েকে ফিরে পাওয়ার আনন্দাশ্রু, মুখে তৃপ্তির হাসি।
মরিয়ম মাকে জানায়, চশমা পরে সে আগের চেয়ে ভালো দেখতে পায়। তবে পুরোপুরি নয়। মায়ের হাত ধরে বলে, “আমি লাল পরী হয়েছি, দেখো!” তার মায়ের অন্ধ চোখে তখনও অশ্রু, কিন্তু কণ্ঠে তৃপ্তি। বিড়বিড় করে বলছিলেন, “আল্লাহ্‌ তুই আমারে ফেরত দিছস।”
অফিসের উপস্থিত সবার চোখেও তখন জল। বিদায়ের মুহূর্তে মরিয়ম ইউএনওর হাত ছাড়ছিল না। নিচে নেমে গাড়িতে ওঠার সময় সে বলল, “এই গাড়িটার রংও তো আমার জামার মতো লাল। একটা ছবি তুলো না।”
রাত ১০টার কিছু পরে, ছোট্ট ‘লাল পরী’ মরিয়ম মায়ের কোলে ফিরে গেল তার ঘরে। যেন, অন্ধকারের ভেতর আলো হয়ে

সর্বাধিক পঠিত