
মুহাম্মদ নঈম উদ্দিন
বদলে যাওয়া উপকূলের রাজনীতি
বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির মানচিত্রে কক্সবাজার–২ (মহেশখালী–কুতুবদিয়া) আসনটি এখন কেবল একটি উপকূলীয় বা দ্বীপভিত্তিক এলাকা নয়; এটি দেশের অর্থনীতির নতুন প্রবেশদ্বার। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও এলএনজি টার্মিনালের মতো মেগা প্রকল্পগুলো এই অঞ্চলকে শত শত কোটি টাকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে।
ফলে এই আসনে বিজয় এখন শুধুমাত্র একটি সংসদীয় আসন জয় নয়—বরং দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতি, কর্মসংস্থান ও স্থানীয় ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের কৌশলগত লড়াই।
এই প্রেক্ষাপটে নির্বাচনী সমীকরণ এখন এক ধরনের অচলাবস্থায় রয়েছে। জামায়াতে ইসলামী ইতোমধ্যে তাদের পরীক্ষিত নেতা হামিদুর রহমান আজাদকে প্রার্থী করে মাঠে নেমেছে। বিপরীতে, দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি এখনো তাদের প্রার্থী ঘোষণা করেনি—যা স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে নানা জল্পনা-কল্পনার জন্ম দিয়েছে।
কৌশলগত অচলাবস্থা: জোট নেই, চাপ আছে
অতীতে এই আসনে বিএনপি ও জামায়াত জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করলেও, এবার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। দুই দলই আলাদা পথে যাচ্ছে, ফলে বিএনপির নীরবতা এখন এক গভীর কৌশলগত জটিলতার রূপ নিয়েছে।
জামায়াত ইতোমধ্যে মাঠে নেমে তাদের ভোটব্যাংক সুসংহত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। তবু বিএনপি প্রার্থী চূড়ান্ত না করায় জামায়াত কৌশলগতভাবে চাপে রয়েছে। প্রার্থী মনোনীত করলেও, তারা পূর্ণ পরিকল্পনা নিয়ে প্রচারণায় নামতে পারছে না।
তারা জানে না, বিএনপি কোন প্রার্থীকে চূড়ান্ত করতে যাচ্ছে এবং সেই প্রার্থীর উপস্থিতি তাদের ভোটের ওপর কী প্রভাব ফেলবে। এই অনিশ্চয়তা জামায়াতের নির্বাচনী গতি ও কৌশল নির্ধারণে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ছোট দলগুলোর ভূমিকা ও ভোটের সমীকরণ
কক্সবাজার–২-এ শুধু বিএনপি ও জামায়াতই নয়, আরও কয়েকটি ছোট দলও প্রার্থী ঘোষণা করেছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফতে মজলিস ও এনসিপি এখন মাঠে সক্রিয়।
এদের কেউ কেউ ভোট কৌশলের মাধ্যমে নিজেদের দর-কষাকষির অবস্থান মজবুত করতে চাইছে, আবার কেউ সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতার লক্ষ্যেই মাঠে নামছে।
ফলে এই আসনে ভোটের বণ্টন আগের তুলনায় অনেক বেশি বিচ্ছিন্ন ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়ে উঠেছে।বিএনপির প্রার্থী ঘোষণার দেরি ছোট দলগুলোকে নিজেদের কৌশল পুনর্বিবেচনায় বাধ্য করছে, যার ফলে সামগ্রিক নির্বাচনী চিত্র আরও জটিল হয়ে উঠছে।
অর্থনীতি, ক্ষমতা ও স্থানীয় রাজনীতির নতুন মানচিত্র
মহেশখালী ও মাতারবাড়ী কেন্দ্রিক মেগা প্রকল্পগুলো এই আসনের রাজনীতিকে অর্থনীতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত করেছে। এখানে রাজনীতি মানে এখন শুধু ভোট নয়—বরং বিনিয়োগ, চুক্তি, ভূমি অধিগ্রহণ, ঠিকাদারি ও স্থানীয় কর্মসংস্থানের নিয়ন্ত্রণও।
যে দল এই আসনে বিজয়ী হবে, তারা ভবিষ্যতের এই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সরাসরি প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পাবে। এই কারণেই সব রাজনৈতিক দল এই আসনে সুকৌশলে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে চাইছে।
কারণ এখানে জয়ের অর্থ শুধু সংসদীয় প্রভাব নয়—বরং অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামাজিক ক্ষমতার নতুন বিন্যাসে প্রবেশাধিকার।
উপসংহার: নীরবতার ঝুঁকি ও সম্ভাবনা
বিএনপি’র নীরবতা এখনো পর্যন্ত অন্য দলগুলোর ওপর কৌশলগত চাপ তৈরি করেছে। তবে একইসঙ্গে এটি তাদের নিজেদের জন্যও এক ঝুঁকিপূর্ণ খেলা।
সময়ের অভাবে সংগঠন দুর্বল হলে বা প্রার্থী দেরিতে এলে মাঠের ভোটারদের টানতে সমস্যা হতে পারে। অন্যদিকে, সঠিক সময়ে সঠিক প্রার্থী এলে পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে।
এই কারণেই—কক্সবাজার–২ এখন এক কৌশলগত লড়াইয়ের মঞ্চ, যেখানে রাজনীতি ও অর্থনীতি মিলেমিশে গেছে।
এই নীরবতা কবে ভাঙবে, আর তা ভাঙলে উপকূলের রাজনীতি কোন পথে যাবে—সেটিই এখন দেখার বিষয়।
